Full-Width Version (true/false)

হিন্দুধর্ম: এক মহাজাগতিক আলিঙ্গনের গল্প

আজ সকালে উঠে জানালার পাশে বসে চায়ের কাপে ভাসতে থাকা ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলামএই বিশাল পৃথিবীতে কতজন মানুষ তাদের হৃদয়ে একই সূর্যের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে? কতজন প্রার্থনার মালা গুঁজে রেখেছে জীবনযাত্রার প্রতিটি ফাঁকে? হিন্দুধর্ম, এই নামটার মধ্যে লুকিয়ে আছে কোটি কোটি মানুষের আশা, সংগ্রাম, আনন্দ, আর অস্তিত্বের গভীর দর্শন। আজকের এই ব্লগে, আমি শুধু সংখ্যা বা তথ্যের গল্প বলব না, বরং শোনাব সেই সব মানুষের গল্প যারা হিন্দুত্বকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই জীবনের অংশ করে নিয়েছে।

হিন্দুধর্ম - Hinduism


. "এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলা..." নাকি "বসুধৈব কুটুম্বকম"? 

হিন্দুধর্মের অনুসারী সংখ্যা প্রায় ১২০ কোটির কাছাকাছিবিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম। কিন্তু সংখ্যাগুলো কি কখনো গভীরতা মাপতে পারে? ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, মরিশাস, ফিজি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের শহরগুলোতেও হিন্দু মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়। কিন্তু এই সংখ্যার আড়ালে লুকিয়ে আছে অগণিত ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সমুদ্র। 

কেউ হয়তো প্রতিদিন গঙ্গাস্নানে যান, কেউ কেরালার মন্দিরে নৈবেদ্য সাজান, কেউ আবার নিউইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টে ইশ্বরের সঙ্গে কথা বলেন ইংরেজিতে! হিন্দুধর্মের সৌন্দর্য এখানেইএটি কোনো একক গ্রন্থ বা নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ নয়। এটি একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক নদী, যার দ্বারা হাজার বছর ধরে শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে মানবতার মরুভূমিকে সিক্ত করে চলেছে।

. "ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ"—ধর্ম আসলে কী? 

হিন্দুদের দর্শনের মূলে আছে "ধর্ম" (নৈতিক কর্তব্য), "কর্ম" (কার্য-কারণের নীতিবিদ্যা), আর "মোক্ষ" (মুক্তির পথ) কিন্তু আজকের যুগে হিন্দু তরুণ-তরুণীরা কী ভাবেন? তাদের অনেকেই বলবেন, "ধর্ম মানে পুজো-অর্চনা নয়, ধর্ম মানে নিজের বিবেকের সঙ্গে বেঁচে থাকা।" 

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৬০% হিন্দু যুবক বিশ্বাস করেন যে বিজ্ঞান ধর্ম পাশাপাশি হাঁটতে পারে। কেউ কেউ মহাভারতের যুদ্ধকে রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন— "কুরুক্ষেত্র আমাদের মনের ভিতরের লড়াই।" আবার কেউ গর্ব করে বলেন, "আমাদের দেবদেবীরা বৈচিত্র্যের প্রতীকনারী, পুরুষ, পশু, প্রকৃতি... সবই তো ঈশ্বরের অংশ।" 

. "অহিংস পরমো ধর্মঃ"—কিন্তু সমাজে কী ঘটছে? 

হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বিতর্কিত দিকটি হলো এর সামাজিক ব্যাধিগুলোজাতিভেদ, নারী-পুরুষের অসমতা, কুসংস্কার। অনেকেই এগুলোকে ধর্মের বিকৃতি বলেন। একজন কলকাতার মহিলা লিখেছিলেন ব্লগে—"আমি হিন্দু, কিন্তু আমি মেনে নেব না যে আমার মাথায় সিঁদুর থাকলেই আমি 'সম্পূর্ণ' ঈশ্বর আমার মনে বাস করেন, কপালে বা চুলে নয়।" 

অন্যদিকে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান বিশ্বজুড়ে বিতর্ক তৈরি করেছে। কেউ এটিকে সনাতন সংস্কৃতি রক্ষার ঢাল বলেন, কেউ বলেন "ধর্মান্ধতা" এই দ্বন্দ্বের মাঝেও সাধারণ হিন্দু পরিবারগুলো প্রতিদিনের পুজো-পাঠে শান্তি খোঁজে। যেমন কানাডার এক প্রবাসী বলেছিলেন, "রোজ সকালে হনুমান চালিসা পাঠ করিএটা আমার মেডিটেশন। রাজনীতি নয়, আমি শুধু আমার শিশুকে ভালোবাসা সম্মানের শিক্ষা দিই।" 

. "বসুধৈব কুটুম্বকম"—সমগ্র পৃথিবীই তো পরিবারঃ

হিন্দু দর্শনের সবচেয়ে প্রগতিশীল দিকটি হলো "বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্ব"-এর ধারণা। উপনিষদে লেখা—"অহং ব্রহ্মাস্মি" (আমিই ব্রহ্ম) এই বাক্য যেন বলে, ঈশ্বর কোনো দূরের সত্তা নন, তিনি আমার ভিতরেই আছেন। তাই আজকের জলবায়ু সংকটে অনেক হিন্দু যুবক প্রকৃতিকে মাতৃরূপে পুজো করেন। কেরালার এক পরিবেশকর্মী বলেন, "নদী আমাদের মা। আমরা তাকে দূষিত করলে, তা শাস্ত্রবিরোধী।" 

. শেষ নয়, একটি শুরুঃ 

হিন্দুধর্ম কখনোই স্থবির নয়। এটি প্রতিমুহূর্তে বদলাচ্ছেকোনোটা ভালো, কোনোটা মন্দ। কিন্তু এর মর্মকথাটি চিরন্তন: "তুমি যা খুঁজছো, তা তুমিই।" আজ যখন পৃথিবী বিভাজন, হিংসা আর উদ্বেগে কাঁপছে, তখন হিন্দুদের (এবং সকলের) এই শিক্ষা প্রাসঙ্গিক—"স্বস্তি প্রজাভ্যঃ পরিপালয়ন্তাম" (সকল প্রাণীর মঙ্গল হোক) 

একটি প্রার্থনা দিয়ে শেষ করিঃ- 

"ওঁ অসতো মা সদ্গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়

(অসত্য থেকে সত্যের দিকে, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে নিয়ে যাও।) 

লেখক: একজন সাধারণ মানুষ, যে বিশ্বাস করেপ্রতিটি ধর্মই ভালোবাসার ভাষা শেখায়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ